নবজাতক জন্মের পর করণীয়
একটি সন্তান প্রত্যেক পিতা-মাতার জন্যই বিধাতার আশীর্বাদ স্বরূপ সন্তান। শুধু বংশবৃদ্ধির জন্যই নয়, বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা একমাত্র অবলম্বনই হলো তা সন্তান। আমরা প্রত্যেকেই চাই সন্তান লালন-পালন করতে। কিন্তু একটি নবজাতক জন্মের পর করণীয় কি বা নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যা কিভাবে করতে হয় সেটা অধিকাংশ পিতা-মাতারই অজানা।
নবজাতকের জন্মের পর তার উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। অনেক পিতা-মাতাই নবজাতকের জন্মের পর করণীয় কি সে ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। আবার কেউ কেউ নবজাতকের জন্মের পর তার যত্ন ও পরিচর্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। তাই আসুন আজকে আমরা উদাসীন বা উদ্বিগ্ন না হয়ে নবজাতকের জন্মের পর করণীয় কি বা নবজাতকের যত্ন ও পরিচর্যার জন্য কি করা দরকার সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করি।
নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় পরিচর্যা
- মোছানোঃ জন্মের সাথে সাথে পরিষ্কার ও শুকনো নরম সুতি কাপড় দিয়ে মোছানো।
- নাড়ির যত্নঃ জীবাণুমুক্ত উপায়ে নাড়ি কেটে ও বেঁধে একবার ক্লোরহেক্সিডিন লাগানো এবং এরপর নাড়িতে অন্য কোন কিছুই না লাগানো ও নাড়ি শুষ্ক রাখা।
- উষ্ণতা বজায় রাখাঃ মোছানোর সাথে সাথে মায়ের ত্বকে ত্বক স্পর্শে রাখা এবং পরবর্তীতে মাথা ও শরীর কাপড়ে জড়িয়ে উষ্ণ রাখা।
- বুকের দুধ খাওয়ানোঃ জন্মের সাথে সাথে অবশ্যই ১ ঘন্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো।
- গোসল না করানোঃ জন্মের তিন দিনের মধ্যে কোনভাবে শিশুকে গোসল না করানো।
নবজাতকের স্বাভাবিক যত্ন
- বুকের দুধ খাওয়াবেন।
- নবজাতক ও মাকে একই বিছানায় রাখবেন।
- নবজাতককে গরম রাখবেন।
- নবজাতকের ঘরে কম লোকজন থাকবেন।
- নবজাতককে ধরার আগে হেক্সিসল দিয়ে হাত ধুয়ে নিবেন।
- ৬ সপ্তাহ বয়সে টিকা দেওয়া শুরু করবেন।
নবজাতকের বয়স যখন ০-২৮ দিন
- শিশুর জন্মের সাথে সাথে ১ ঘন্টার মধ্যে তাকে মায়ের স্তন চুষতে দিতে হবে।
- মায়ের দুধ ছাড়া শিশুকে মধু, চিনির পানি, পানি, তেল বা কোন কিছুই দেয়া যাবে না।
- মা ও শিশুর অবস্থান (পজিশন) হবে মা পিঠ হেলান দিয়ে বসতে হবে, শিশুর পিঠ ও পাছা ভালোভাবে ধরতে হবে, শিশুর শরীর ও মুখ মায়ের দিকে ফেরানো থাকবে।
- মায়ের বুকে ভালো ভাবে লেগেছে বা এটাচমেন্ট হয়েছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।
- শিশুর নিচের ঠোঁট উল্টানো এবং সে বড় হা করেছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে।
- দেখতে হবে স্তনের কালো অংশের বেশির ভাগ শিশুর মুখের ভেতর আছে এবং দুধ গেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কিনা।
- বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের হাত সি এর মত করে স্তন ধরবেন।
শিশুর বয়স যখন ০-৬ মাস
- মায়ের বুকের দুধের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
- দুধের পরিমাণ বাড়াতে স্তন খালি করতে হবে।
- ঘন ঘন মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
- প্রত্যেকবার বেশি করে সময় নিয়ে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
- অবস্থান (পজিশন) মায়ের বুকে ঠিক ভাবে লেগে আছে কিনা অর্থাৎ এটাচমেন্ট খেয়াল করতে হবে।
- অন্য কোন খাবার এমন কি পানিও খাওয়ানো যাবে না।
- মা যদি বাইরে যায়, দুধ গেলে কাপে বা চামচ করে শিশুকে খাওয়াবে।
- কখনোই বোতল ব্যবহার করা যাবে না।
শিশুর বয়স যখন ৬-৮ মাস
- পারিবারিক চটকানো খাবার
- প্রতিদিন মাছ বা ডিম বা মুরগির কলিজা বা মাংস সাথে ঘন ডাল, শাক, হলুদ সবজি, ফল, তেলে ভাজা খাবার।
- ১ পোয়া বাটির ১/২ বাটি করে দিনে ২ বার এবং ১-২ বার পুষ্টিকর নাস্তা যেমন- পাকা কলা, পাকা পেঁপে, সুজি, হালুয়া, পায়েস, ফিরনি, নরম ভাত, আলু সিদ্ধ, দই, খিচুড়ি।
শিশুর বয়স যখন ৯-১১ মাস
- সময় নিয়ে শিশুকে নিজে নিজে খেতে শেখানো।
- প্রতিদিন মাছ বা ডিম বা মুরগির কলিজা বা মাংস সাথে ঘন ডাল, শাক, হলুদ সবজি, ফল ও তেলে ভাজা খাবার দেয়া।
- দিনে তিনবার ১/২বাটি এবং ১-২ পুষ্টিকর নাস্তা যেমন- পাকা আম, পাকা পেঁপে, কাঁঠাল, সিদ্ধ ডিম দেয়া।
শিশুর বয়স যখন ১২-২৩ মাস
- শিশুকে নিজে নিজে খেতে উৎসাহ দিতে হবে।
- প্রতিদিন মাছ বা ডিম বা মুরগির কলিজা সাথে ঘন ডাল, শাক, হলুদ সবজি ও ফল+১ চা চামচ তেল অথবা তেলে ভাজা খাবার এবং গরুর দুধ দিয়ে তৈরি খাবার।
- প্রতিদিন ৩ বাটি খাবার এবং ১-২ বার পুষ্টিকর নাস্তা যেমন- পাকা আম, পাকা পেঁপে, কাঁঠাল, সিদ্ধ ডিম।
শিশু যথেষ্ট পরিমাণ দুধ পাচ্ছে কিনা তা বুঝার উপায়
- দিনে-রাতে কমপক্ষে ৬ বার প্রস্রাব করছে।
- ভালোভাবে ঘুমায় ও খেলাধুলা করে।
- ওজন বাড়ছে।
মায়ের দুধ যেভাবে গালতে হয়
- মাকে চিন্তা মুক্ত খুশি মনে থাকতে হবে।
- একটি বড় মুখের বাটি ও দুই হাত সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- বাটি স্তনের নিচে ধরতে হবে।
- স্তনের উপরে বুড়া আঙ্গুল ও স্তনের নিচের কালো অংশের বাইরে বাকি চারটি আঙ্গুল থাকবে।
- স্তন চাপ দিয়ে বোঁটার দিকে আনতে হবে।
- কোন অবস্থাতেই বোঁটায় চাপ দেয়া যাবে না।
- সব আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত স্তনে চাপ দিয়ে দুধ গালতে হবে।
- দুধ গালার পরে বাটিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
শিশুর জন্য খিচুড়ি যেভাবে তৈরি করবেন
- আতপ চাল ২ মুঠ
- মসুর ডাল ১ মুঠ
- তেল ৩০ মিলি
- ডিম ১ টি
- আলু ১ টি
- মিষ্টি কুমড়া পরিমাণ মতো
- মসলা পরিমাণ মতো
পুষ্টিকর খাবার ও নাস্তা
প্রত্যেক গ্রুপ থেকে প্রতিদিন একটি করে খাবার দিতে হবে।
- মাছ, ডিম, মুরগির কলিজা, মাংস
- দই, পনির, সেমাই, পায়েস, ফিরনি, ক্ষীর
- শাক, পাকা আম, পাকা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, কাঁঠাল
- ঘন ডাল
- তেলে ভাজা খাবার, ঘি, মাখন, বাদাম
শিশু যারা খেতে চায় না
- যখন ক্ষুধা পাবে তখন খাওয়াবেন।
- বিভিন্ন ধরনের খাবার বারবার দিতে হবে কারণ একই ধরনের খাবার বারবার খাবে না।
- জুস, পানীয়, চকলেট, চিপস জাতীয় খাবার খাওয়ানো যাবে না।
- উৎসাহ দিয়ে ও প্রশংসা করে খাওয়াতে হবে।
- সময় নিয়ে ও ধৈর্য ধরে খাওয়াতে হবে।
- শিশুকে তার পছন্দের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
- কখনোই জোর করা যাবেনা।
অসুস্থ শিশুকে খাওয়ানো
- ঘন ঘন মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
- তার পছন্দের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
- অল্প অল্প করে ঘন ঘন খেতে দিতে হবে।
- অসুখ থেকে সেরে উঠলে আগের ওজন না হওয়া পর্যন্ত অন্তত ১ সপ্তাহ বেশি পরিমাণে ঘন ঘন পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
- শিশুকে রোগমুক্ত রাখতে খাওয়ানোর আগে সব সময় সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
জ্বরের সময় করণীয়
- জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলে প্যারাসিটামল সিরাপ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দিতে হবে।
- জ্বর ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট হবার সাথে সাথে কুসুম গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে সমস্ত শরীর ও মাথা ৩-৫ মিনিট মুছে দিবেন।
- জ্বর খিচুনি থাকলে (Fehrile Convulsion)
- Tab. Sedil 5mg (দিনে ৩ বার ৩ দিন খাবে)
[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ১ ও ৩ নং ঔষধ সব সময় ঘরে জমা রাখবেন]
কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর জন্য উপদেশ
- বারবার পানি খাওয়াবেন।
- বেশি চিনি দিয়ে দুধ খাওয়াবেন।
- শাক-সবজি, নিরামিষ, ভেজিটেবল সুপ বেশী বেশী খাওয়াবেন।
- পাকা আম, পাকা পেঁপে, বেলের শরবত খাওয়াবেন।
- প্রতিদিন একই সময়ে পায়খানা করানোর চেষ্টা করবেন।
ডায়রিয়া রোগের জন্য উপদেশ
- ঘন ঘন খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
- বুকের দুধ বন্ধ না করে ঘন ঘন খাওয়াতে হবে।
- কাশি হলে স্যালাইন খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।
- স্বাভাবিক খাবার চলবে, অধিক চিনিযুক্ত খাবার ও ফলের রস খাওয়াবেন না।
- কাঁচা কলা ভর্তা, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, ভাতের মাড় ঘন ঘন খাওয়াবেন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url