রাসেল'স ভাইপার - গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে সত্য জানুন
সম্প্রতি রাসেল'স ভাইপার নামক এক প্রজাতির বিষধর সাপ নিয়ে তোলপাড় চলছে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াগুলোয়। Wildlife And Snake Rescue Team in Bangladesh-WSRTBD এর একটি দল সাপটির ডিস্ট্রিবিউশন ম্যাপ তৈরী করতে গিয়ে নাটোর জেলার পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলে রাসেল'স ভাইপারের বিস্তার লক্ষ করেছেন। এই অঞ্চলসহ সারা দেশেই রাসেল'স ভাইপার এখন একটি আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।
মিডিয়াগুলো সবসময় পাঠক বা দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণের আশায় যেকোনো নিউজ অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করে । তবে রাসেল'স ভাইপার ইস্যুতে এই প্রচেষ্টা করতে গিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে এই সাপ সম্পর্কে। গুজবগুলোর ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ভীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে। রাসেল'স ভাইপার সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়া তথ্য গুলোর সত্যতা যাচাই করা যাক।
ছড়িয়ে পড়া তথ্যের সত্যতা যাচাই
- মিডিয়াগুলোতে প্রচার করা হচ্ছে রাসেল'স ভাইপার বিশ্বের সর্বোচ্চ বিষধর সাপগুলোর অন্যতম। অথচ বিষের তীব্রতা অনুযায়ী এটি বিশ্বের সেরা ৩০ এর তালিকাতেও নেই। এমনকি বাংলাদেশেই রাসেল'স ভাইপারের চেয়ে বিষধর প্রজাতির অনেক সাপ রয়েছে।
- রাসেল'স ভাইপারের অ্যান্টিভেনোম নেই বা অ্যান্টিভেনোম কাজ করেনা এটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। রাসেল'স ভাইপারের যথাযথ অ্যান্টিভেনোম পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ রয়েছে এবং এটি যথেষ্ট কার্যকর।
- রাসেল'স ভাইপার কখনো তাড়া করে কামড়ায় না। এরা অ্যাম্বুশ হান্টার, অর্থাৎ ওঁত পেতে থেকে শিকার করে। রাসেল'স ভাইপারের পক্ষে কখনোই তাড়া করে কামড়ানো সম্ভব না।
- রাসেল'স ভাইপারের পরিমাণ ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কিছু নতুন এলাকায় রাসেল'স ভাইপার পাওয়া গেলেও এটা বলা ভুল হবে যে এটি ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি মূলত পদ্মা নদীর অববাহিকা ধরে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
- অনেক মানুষ এর কামড়ে মারা যাচ্ছে এই তথ্যটিও পুরোপুরি সঠিক নয়। ২০১৬ সালে বর্তমানের তুলনায় আরো বেশি মানুষ রাসেল'স ভাইপারের কামড়ের শিকার হয়েছিল। তবে বর্তমান সময়ে রাসেল'স ভাইপারকে বিভিন্ন মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে বলে এটি সবার কাছে বেশি মনে হচ্ছে।
- অনেক জায়গায় প্রচার করা হচ্ছে রাসেল'স ভাইপার কামড় দিলে নাকি সাথেসাথেই মানুষের মৃত্যু হয়, এটাও পুরোপুরি ভুল তথ্য। পৃথিবীর সবথেকে বিষধর সাপ "ইনল্যান্ড টাইপ্যান"ও যদি কোনো মানুষকে কামড় দেয় তাহলেও ২০-২৫ মিনিট পরে মৃত্যু হবে। বিষ হেমোটক্সিন হওয়ায় রাসেল'স ভাইপারের প্রভাবে মৃত্যু হতে বেশি সময় লাগে। ৭ ঘন্টা-৮ দিন পর্যন্ত রাসেল'স ভাইপারের কামড়ে মানুষ বেঁচে থাকতে সক্ষম।
- এটি ভারত থেকে আসা সাপ তথ্যটি সঠিক নয়। সেই বৃটিশ আমল থেকেই এই সাপ বাংলাদেশের স্থানীয়। এটি মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিপ্রাণী। ভারত থেকে এদেশে এই সাপ সম্প্রতি ছড়িয়েছে এমন তথ্য একদমই অযৌক্তিক।
সাপের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে কিছু পদক্ষেপ
এরকম হাজারো ভুল তথ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেড়াচ্ছে অনলাইন অফলাইন জুড়ে। তবে প্রতি বছরই জুলাই মাসে রাসেল'স ভাইপারের এর এমন ছড়িয়ে পড়া লক্ষ করা যায় কারণ এই সময়ে রাসেল'স ভাইপার বাচ্চা প্রসব করে। এখন এদের আচরণেও কিছু পরিবর্তন আসবে। যেহেতু রাসেল'স ভাইপার দেখা গেছে তাই আমাদেরকেও পর্যাপ্ত সচেতনতা গ্রহণ করা জরুরী। যেকোনো সাপের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন:
- বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যাতে কোনো ইঁদুর, ব্যাঙ বা পোকামাকড়ের আনাগোনা না থাকে। সাপ মূলত খাবারের খোঁজেই মানুষের বসতবাড়ির আশেপাশে চলে আসে।
- অযথা ফেনল বা কার্বলিক এসিডের বোতল বাড়িতে রাখা যাবে না। সাপ তাড়াতে বৈজ্ঞানিক ভাবে ফেনল বা কার্বলিক এসিডের কার্যকারীতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। উল্টো এতে মানুষের ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
- বাড়ীর অভ্যন্তরীন পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ির বেঁচে যাওয়া খাবার আশেপাশে ফেলা যাবেনা। এতে করে ইঁদুর এবং পোকামাকড় আসতে পারে। আর ইঁদুরের সন্ধানে সাপও চলে আসতে পারে।
- বাড়ির বা বাড়ির আশেপাশে মাটিতে কোন গর্ত বা গ্রাউন্ড ফ্লোরের দেয়ালে সাপ প্রবেশের মতো বড় ফাটল থাকলে তা বন্ধ করে দিতে হবে।
যেকোনো সাপের কামড় খাওয়ার পর করণীয়
- সাপের কামড়ের পর প্রথম ১০০ মিনিট সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করলে রোগীর রিকভারি রেট ১০০% থাকে। তাই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে। প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিভেনোম মজুদ আছে।
- ওঝা বা কবিরাজের কাছে গিয়ে প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ সময় টুকু নষ্ট করবেন না। লেট ট্রিটমেন্ট করালে রোগীর দেহে অ্যান্টিভেনোম কাজ করার হার কমে যায় অনেকটা।
- ব্লাড সার্কুলেশন বেড়ে যায় এমন সমস্ত কাজ এড়িয়ে চলতে হবে রেগীকে।
- আক্রান্ত স্থানে বাঁধন দেয়া যাবে না বা কেনোরকম কাটাচেঁড়া করা যাবেনা৷ আমরা অনেকেই সাপের কামড়ের পরে বাঁধন দিতে যাই, এটি একটি ভুল পদক্ষেপ। কখনো এই কাজ করা যাবেনা। বাঁধন দিলে রোগীর অঙ্গহানির তীব্র সম্ভাবনা থাকে, বিশেষ করে রাসেল'স ভাইপারের কামড়ে।
সর্বোপরি একটাই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সাপের কামড়ের পরে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া সরাসরি উপজেলা বা জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হবে। সাপ দেখলেই তেড়ে মারতে যাবেন না। শুধুমাত্র সাপ মারতে গিয়ে প্রতিবছর অনেক লোক সাপের কামড়ের শিকার হয়। কিছু সাপ চোখের পলকে কামড়ে দিতে সক্ষম।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আশেপাশে সাপ দেখলে অবশ্যই WSRTBD সার্টিফাইড রেস্কিউ টিমকে জানাবেন। বিশেষ প্রয়োজনে সাপ উদ্ধারে ৯৯৯ এ ফোন করবেন। সাপসহ যেকোনো বন্যপ্রাণী সম্পর্কে জ্ঞান, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উদ্ধারকার্য পরিচালনার জন্য Wildlife And Snake Rescue Team In Bangladesh (WSRTBD) এর সাথে যুক্ত হতে পারেন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url