চুল পড়া রোধের ঘরোয়া উপায়
দিন দিন চুল পড়ে যাচ্ছে! চুল পড়া কোনভাবেই ঠেকাতে পারছেন না! করণীয় কি ভেবে পাচ্ছেন না! এ সকল বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে পেয়েছি এবং তা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বর্তমানে আবহাওয়া, আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং চুলের যত্নের অভাবে অনেকেই অল্প বয়সে চুল হারিয়ে ফেলছেন। আবার জিনগত কিছু কারণেও অনেকের মাথা টাক হয়ে যাচ্ছে।
আজকের এই আর্টিকেলে চুল পড়া বন্ধের ঘরোয়া কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করব। এর মধ্যে রয়েছে চুল ঘন, কালো এবং মজবুত করে এমন কয়েকটি খাবার, তেল ও ভিটামিন ট্যাবলেট যা নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। আর শেষে থাকছে চুলের যত্ন নেয়ার সঠিক উপায় ও আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে পরামর্শ।
খাবার
চুল পড়া বন্ধের জন্য বেশ কয়েকটি খাবার খুবই উপকারী। চুলকে সুস্থ সুন্দর ঘন কালো ও মজবুত করতে এই খাবারগুলো আপনাকে সাহায্য করবে। আজকের আলোচনায় এমন দশটি খাবারের কথা বলব যেগুলো ভেতর থেকে চুলে পুষ্টি যোগাবে।
বাদাম
চুল সুস্থ, সুন্দর, ঘন, কালো ও মজবুত রাখতে বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন চীনা বাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম, ওয়ালনাট খেতে পারেন। এগুলোতে আছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, বিশেষ করে ওমেগা-৬ ফ্যাট যা চুলের গোড়া সতেজ রাখতে আর চুল লম্বা করতে সাহায্য করে। এই ওমেগা-৬ ফ্যাট আমাদের শরীর নিজে থেকে তৈরি করতে পারেনা, খাবার থেকে নিতে হয়। এটার অভাবে মাথার চুল পড়ে যায়, চুলের রং হালকা হয়ে যায়। তাই প্রতিদিনের নাস্তায় কিছু বাদাম রাখতে পারেন। তবে অনেক পরিমানে খাবেন না, তাহলে ওজন বেড়ে যেতে পারে।
হলুদ ও কমলা রঙের সবজি এবং ফলমূল
চুলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলুদ ও কমলা রঙের সবজি এবং ফলমূল যেমন- গাজর, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, আম খেতে পারেন। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে। চুলের ফলিকল অর্থাৎ চুলের গোড়া যেখান থেকে চুলটা বড় হয়, সেইটা ঠিক মত কাজ করার জন্য দরকার ভিটামিন-এ এবং সেটার খুব ভালো উৎস হলো এই হলুদ ও কমলা রঙের ফল ও সবজি। দিনে আমাদের শরীরে যতখানি ভিটামিন এ দরকার, আধা কাপ গাজরে তার অর্ধেকের বেশি হয়ে যায়। তাই দিনে কিছু হলুদ ফল ও সবজি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
তৈলাক্ত মাছ
প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে ওমেগা-৩ ফ্যাটের জন্য সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। যেমন- টুনা, স্যামন। তবে আমাদের দেশি মাছ যেমন- ইলিশ, কই, মলা, চাপিলা এগুলোতে ওমেগা-৩ ফ্যাট আছে। এগুলো চুল ঘন, কালো করতে সাহায্য করে সাথে প্রোটিনেরও ভালো উৎস।
ডিম
সুন্দর চুলের জন্য ডিম আপনার খুব ভালো বন্ধু। ডিম কেন ভালো বন্ধু সে সম্পর্কে একটু ধারনা দেই। আমাদের চুল শর্করা বা ফ্যাটের তৈরি না। চুল প্রায় পুরোটাই প্রোটিনের তৈরি। আর গবেষণা থেকে জানা যায় যে খাবারের প্রোটিনের অভাব হলে চুল পড়ে যায়। কিন্তু আমাদের অনেকের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন থাকে না। কারন আমরা ভাতটাই বেশি খায়। তাই সুন্দর চুলের জন্য খাবারের তালিকায় ডিম রাখবেন, সাথে ডিমে আরো কিছু বোনাস উপাদান আছে যেমন বায়োটিন, সেলিনিয়াম, ভিটামিন বি-১২ ইত্যাদি। এগুলো চুল ঘন, কালো আর সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
পালং শাক
চুলের উপকারে পালং শাক একটা চমৎকার খাবার। এতে চারটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে যা চুলের ভেতর থেকে পুষ্টি যোগায় ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, আয়রন ও ফলেট। এই সবগুলোই ঘন, কালো, সুন্দর চুলের জন্য প্রয়োজন।
ডাল
সুন্দর চুলের জন্য ডাল খুব উপকারী। ডালে প্রোটিন আছে এবং আয়রনও আছে ভালো পরিমাণে। আয়রন আমাদের মাথার তালুতে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে চুলের গোড়াতে অক্সিজেন পৌঁছাতে সাহায্য করে। গবেষণা থেকে জানা যায় যে আয়রনের অভাবে চুল পড়ে। সুন্দর চুলের জন্য ডালে আরো কিছু বোনাস উপাদান আছে যেমন- জিঙ্ক, ফলেট। খুব পাতলা ডাল না খেয়ে ঘন করে ডাল রান্না করে খেলে এই পুষ্টি উপাদানগুলো পাবেন।
বিভিন্ন ধরনের বীজ
চুলের সুস্থতার জন্য বিভিন্ন ধরনের বীজ যেমন- সিয়া সীড, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখীর বিচি, তিসির বীজ ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন। এ সকল বীজে সুন্দর চুলের জন্য উপকারী অনেকগুলো চমৎকার উপাদান আছে। যেমন শিয়া সিডে আছে প্রচুর পরিমাণে আলফা লিনোলিনিক এসিড, এক প্রকারের ওমেগা ৩ ফ্যাট। আবার মিষ্টি কুমড়ার বিচিতে আছে জিংক। অন্যদিকে সূর্যমুখীর বিচিতে আছে বায়োটিন এবং তিসির বীজে আছে সেলেনিয়াম। গবেষণায় পাওয়া যায় চুল পড়ার সাথে এগুলোর অভাবের সম্পর্ক বিদ্যমান। ভাত খাওয়ার সময় তরকারির উপরে একটু বীজ ছিটিয়ে নিয়ে খেতে পারেন। রাতে টক দই, অল্প পরিমান দুধ এবং শিয়া সিডস মাখিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। সকালে সেটা কিছু ফলের সাথে খেয়ে নিতে পারেন।
ছোলা
সুস্থ চুলের জন্য তিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আয়রন, জিংক এবং প্রোটিন। এই তিনটা উপাদানের যে কোনটার অভাব হলে চুল পড়তে পারে। তাই চুল সুস্থ ও সুন্দর রাখতে মাঝে মাঝেই খাবারে ছোলা রাখতে পারেন।
টক দই
টক দই প্রোটিনের আরেকটি অন্যতম উৎস। টক দইয়ে চুলের জন্য উপকারী বেশ কিছু উপাদান আছে যেমন- জিঙ্ক। তবে প্রোটিনের জন্য মুরগির মাংস ভালো খাবার।
টক ফল
বিভিন্ন ধরনের টক ফল যেমন- কমলা, মাল্টা, লেবু, কিউই ফল ইত্যাদি চুলের জন্য খুব উপকারী। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। সুন্দর চুলের জন্য ভিটামিন সি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি এর অভাব হলে চুল বেঁকিয়ে পেঁচিয়ে যায়। মেডিকেলের ভাষায় এটাকে বলে "Corkscrew Hair"। শরীরে আয়রন শোষণ করার জন্য ভিটামিন সি এর প্রয়োজন হয়। শরীর আয়রন শোষণ করতে না পারলে চুল পড়ে যায়।
শরীর নিজে থেকে ভিটামিন সি বানাতে পারেনা। তবে টক জাতীয় ফল খেলে খুব সহজেই সেখান থেকে ভিটামিন সি নিয়ে নিতে পারে। যেমন একটা কমলা থেকেই দিনের প্রায় ৮০ শতাংশ ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। যারা টক একটু কম খেতে পারেন তাদের জন্য টমেটো, পেয়ারা এই ফলগুলো ভিটামিন সি এর ভালো উৎস হতে পারে।
তেল ও ভিটামিন ট্যাবলেট
চুলে বাইরে থেকে পুষ্টি দেয়ার জন্য বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করা যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলেও তেল ও ভিটামিন ট্যাবলেট এর ব্যবহার। চলুন এ বিষয়ে কিছুটা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।
পাম্পকিন সিডিউল বা কদুর তেল
চুল পড়ে যাচ্ছে এমন রোগীদের ওপর করা একটা গবেষণায় দেখা গেছে যে এই তেলটা তিন মাস ব্যবহার করার পরে তাদের নতুন করে চুল গজিয়েছে আর চুল আগের থেকে মোটা হয়েছে। তাই কদুর তেল ব্যবহার করে দেখতে পারেন। আপনারা যে কোন ব্র্যান্ডের কদুর তেল ব্যবহার করতে পারেন। তাতে চুল পড়া ঠেকাতে সাহায্য হতে পারে।
ভিটামিন ট্যাবলেট
এখন আসি চুল পড়া ঠেকাতে কোন ভিটামিন ট্যাবলেট কার্যকর। বাজারে অনেক ধরনের ভিটামিন ট্যাবলেট বিক্রি হয়। অনেক চমকপ্রদক কথাবার্তা লেখা থাকে সেখানে। তবে এর বেশিরভাগ এরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অযথা টাকা অপচয়। চুলের বেশিরভাগ পুষ্টি উপাদান আলাদা ট্যাবলেটের চেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে আসলেই ভালো হয়। তবে এক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম আছে সেটা হল ভিটামিন ডি।
খাবার থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া খুব কঠিন। ভিটামিন ডি পাওয়ার সহজ উপায় হল রোদের সময় কাটানো। তবে যাদের পক্ষে এইটা সম্ভব না তারা আলাদা করে ভিটামিন ডি ট্যাবলেট খেতে পারেন। ভিটামিন ট্যাবলেট এর ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকবেন। কারণ অতিরিক্ত ট্যাবলেট নিলেও চুল পড়তে পারে। যেমন অতিরিক্ত ভিটামিন এ ট্যাবলেট খেলে চুল পড়ে যায়। কিন্তু আপনি হলুদ রঙের সবজি খেয়ে শরীরে যতই ভিটামিন এ ঢুকান না কেন তাতে ক্ষতি নাই।
চুলের যত্নে কমন কিছু ভুল
- অনেকে চুলে শ্যাম্পু করার পরে কন্ডিশনার ব্যবহার করেন না। এইটা চুলের জন্য ক্ষতিকর। কারণটা বুঝিয়ে বলি। আমাদের মাথার তালু থেকে এমনিতেই কিছু তেল আসে যা চুল ভালো থাকার জন্য দরকার হয়। কিন্তু শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেললে সেই তেলটাও ধুয়ে চলে যায়। আর তেলগুলো আবার চুলে ফেরত দেয়াই হচ্ছে কন্ডিশনারের কাজ। তাই প্রতিবার শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ার পরে চুলে কন্ডিশনার লাগাবেন।
- চুল ভেজা অবস্থায় ঘষে ঘষে মুছবেন না। আমরা অনেকেই গোসল করে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে একদম ঘষে ঘষে মুছে। এতে চুল নষ্ট হয়। তাই তোয়ালে দিয়ে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে দিয়ে চুলের পানি বের করবেন।
- চুল ভেজা অবস্থায় আছড়াবেন না। এতেও চুল নষ্ট হয়। চুল বেশি কোঁকড়া না হলে একটু শুকিয়ে যাওয়ার পর চওড়া দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াবেন।
- ব্লো ড্রায়ার বা কার্লিং আয়রন দিয়ে চুল শুকানো থেকে বিরত থাকুন। চুল বাতাসে শুকিয়ে নেয়া সবচেয়ে ভালো। তবে ব্লো ড্রায়ার বা কার্লিং আয়রন ব্যবহার করতেই হয় তাহলে সবচেয়ে কম হিটে ব্যবহার করবেন। যত অল্প সময় ধরে ব্যবহার করা যায় ততই ভালো। সপ্তাহে একবারের বেশি ব্যবহার না করাই উত্তম।
- খুব টাইট করে চুল বাঁধবেন না। খুব টাইট করে চুল বেঁধে রাখলে সেই টানের কারণে চুল পড়তে পারে। এটাকে ট্র্যাকশন এলোপেশিয়া বলা হয়।
চুল পড়ার চিকিৎসা
চুল পড়ার কারণ হতে পারে কিছু রোগ যেমন- থাইরয়েড এর রোগ, রক্তশূন্যতা। আপনার যদি খাবার দাবার ঠিক থাকে, আবার চুলের যত্নও নেয়া হচ্ছে ঠিকমতো, তাও যদি চুল পড়তে থাকে তাহলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। কোন রোগের কারণে এমন হচ্ছে কিনা তিনি খতিয়ে দেখতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারবেন।
চুল পড়তে থাকার একটি অন্যতম কারণ হলো অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া নামক একটি রোগ। সাধারণত ছেলেদের মাথায় টাক পড়া শুরু করে এই রোগের প্রভাবে। কপালের দুইপাশ থেকে টাক হতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সাধারণত টাক হয় না তবে চুল পাতলা হয়ে যায়, মাথায় সিঁথি বড় হয়ে যায়। এই দুই ধরনের সমস্যারই চিকিৎসা আছে। এক্ষেত্রে মিনক্সিডিল আর ফিনাস্টেরাইড ওষুধ দুইটা খুব ভালো কাজ করে। তবে অবশ্যই ওষুধ নেওয়ার পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন আপনার এই রোগটা হয়েছে কিনা এবং কোন ওষুধে ভালো হতে পারে।
ওষুধ ছাড়াও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট, পিআরপি থেরাপির মত আরো কিছু উন্নত চিকিৎসা দেশে হচ্ছে। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট হলো মাথার পিছন থেকে চুল এনে সামনে বসানো। আবার পিআরপি থেরাপিতেও কেউ কেউ বেশ উপকার পাচ্ছেন। অর্থাৎ চুল পড়া রোধের অনেক ধরনের চিকিৎসা আছে।তাই একজন ডার্মাটোলজিস্ট বা স্কিনের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন।
T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url