বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের খাবার তালিকা - কী খাবেন আর কী খাবেন না

একটি নবজাতকের পুষ্টির চাহিদা পূরণের সবচেয়ে ভালো এবং একমাত্র উৎস হলো মায়ের বুকের দুধ। কিন্তু যেই মা এই নবজাতককে পুষ্টি সরবরাহ করছেন তার পুষ্টির দিকটা আমাদের চিন্তা করাটা জরুরী।কেননা  শিশুর পুষ্টি স্তন্যদানকারী মায়ের পুষ্টির উপরে নির্ভরশীল। তাই মায়ের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য বিশেষ কিছু খাবার প্রতি দিনের খাদ্য তালিকায় যোগ করা ভালো।

বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের খাবার তালিকা

সাধারনত স্তন্যদানকারী মায়েদের কঠিন ও জটিল কোনো ডায়েটের প্রয়োজন নেই। তবে খাদ্য তালিকায় কিছু খাবার যোগ করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়, আবার কিছু খাবার খেতে গেলে সতর্ক থাকতে হয়। আজকে আপনাদের সেগুলোই ব্যাখ্যা করব।

বুকের দুধ খাওয়ানো মা যা খাবেন

প্রথমেই বলবো কোন খাবারগুলো স্তন্যদান কারী মায়েদের খাবার তালিকায় যোগ করতে হবে। নিম্নোক্ত খাবারগুলো নিয়মিত এবং পরিমাণমত খেলে স্তন্যদানকারী মায়ের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি শিশুরও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করবে। শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পানি

মায়ের দুধ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পানি। কারণ বুকের দুধের ৮৮% পানি। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলছেন, একজন স্তন্যদানকারী মায়ের প্রতিদিন কমপক্ষে ১.৫- ২ লিটার পানি পান করতে হবে। পানির পরিমাণ মাপতে ২ লিটারের একটি জগে পানি রাখুন এবং সারাদিন সেখান থেকে পানি খেয়ে শেষ করুন।

দুধ, সুপ ও বিভিন্ন প্রকার তরল খেয়েও পানির চাহিদা পূরণ করা যায়। দিনে অন্তত ১ গ্লাস চিনি ছাড়া ফলের শরবত খেলে ভালো হয়। সবচেয়ে বেশি ভালো হয় যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর আগে ১ গ্লাস পানি বা কোন তরল খাবার খাওয়া যায়। এতে দুধ নিঃসরণ ভালো হয়। পানি খাওয়ার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি সারা দিনের সব খাবারের পুষ্টিগুণ শোষণ করতে সহায়তা করে। সেই সাথে হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকিও দূর করে।

ক্যালোরি

বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের প্রতিদিন বেশি ক্যালোরির প্রয়োজন হয় যেটা প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ কিলোক্যালরি। স্বাভাবিক সময় এর থেকে ক্যালোরি বেশি লাগে কারণ দুধ তৈরিতে মায়ের শরীর থেকে অনেক ক্যালোরি খরচ হয়ে যায়। তাই  মায়ের খরচ হয়ে যাওয়া এই ক্যালোরি পূরণের জন্য মায়ের খাবারে এক্সট্রা ক্যালোরি যোগ করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা CDC বলছে, স্তন্যপান করানো মাকে প্রতিদিন ২০০০-২৮০০ কিলোক্যালরি খাবার খেতে হবে। এই ক্যালোরি এর পরিমাণ মায়ের বয়স, ওজন, উচ্চতা, তিনি কতটা কর্মঠ এবং শিশুকে কি পরিমান বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন সেটার উপরে নির্ভর করবে। তবে মায়ের ওজন যদি স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেড়ে যায়, তাহলে হুট করে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হবে না। এজন্য এক বছর ধরে ওজন কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে।

প্রোটিন বা আমিষ

বৃটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে প্রোটিন লাগে ৫০ গ্রাম। আর বুকের দুধ খাওয়ালে প্রোটিন লাগে ৭৫ গ্রাম। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থার থেকে ২৫ গ্রাম বেশি। এই প্রোটিন মায়েরা মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, বাদাম ইত্যাদি থেকে পেতে পারেন। প্রতিদিন তিন বেলা এই খাবারগুলো আপনার প্লেটে রাখুন। দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় খাবারে প্রচুর প্রোটিন থাকে। এজন্য প্রতিদিন ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও পানির চাহিদা পূরণ করতে ২ গ্লাস করে দুধ খেলে ভালো। তবে মায়ের যদি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকে, দুধ সহজে হজম হয় না, গ্যাস হয় তাহলে ছোয়া কাঠ বাদাম দুধ খেয়ে দেখতে পারেন। তবে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

চর্বি বা ফ্যাট

সিঙ্গাপুরের হেলথ প্রোমোশন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বুকের দুধের ৫০ শতাংশ ক্যালরি চর্বি থেকে আসে। সুতরাং স্তন্যদানকারী মাকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট খেতে হবে। আনসাচুুরেটেড ফ্যাট হল সেই ফ্যাট যে ফ্যাট স্বাভাবিক তাপমাত্রায় জমে যায় না। এই ফ্যাট মাছ, মুরগির মাংস, ডিম এবং বাদামে পাওয়া যায়। ফ্যাট বা চর্বি শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফ্যাট লাগে দিনে ২০ গ্রাম কিন্তু স্তন্যদানকারী মায়েদের প্রয়োজন হয় দিনে ৪৫ গ্রাম।

শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট

মায়েদের কর্মদক্ষতা ও শক্তি ফেরাতে এবং শিশুর শারীরিক বিকাশে শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশ প্রয়োজন। রুটি, পাউরুটি, ভাত, আলু, সিরিয়াল বিভিন্ন ধরনের ডালে প্রচুর পরিমাণে শর্করা পাওয়া যায়। স্তন্যদানকারী মায়ের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই খাবারগুলো যুক্ত করুন। তবে এই খাবারগুলো স্বাভাবিক সময়ের মতো খেলেই ভালো। অন্যথায়, বেশি খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে।

ভিটামিন ও ফাইবার

বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় একজন মায়ের সব ধরনের ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি, ফলেড এবং ভিটামিন বি-১২। এজন্য বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী শাক যেমন- পালং শাক, কচু শাক, কলমি শাক, মিষ্টি কুমড়ার শাক, সেই সঙ্গে পানি সমৃদ্ধ সবজি যেমন- লাউ, ঝিঙ্গা, ঢেঁড়স ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। আরো যোগ করতে হবে মৌসুমী ফল বা ফলের জুস যেমন- কলা, পেঁপে, পেয়ারা, বেল, আম, জাম, কাঁঠাল। প্রতিদিন সবুজ ও হলুদ রঙের ৩ ধরনের সবজি এবং ২ ধরনের ফল খাওয়া প্রয়োজন বলছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।

নতুন মায়েরা সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এ সকল খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় এই সমস্যাও কেটে যায়। ডিমের কুসুমে ভিটামিন ডি, মিনারেলস এবং অন্যান্য পুষ্টিও রয়েছে যা মা ও শিশুর হাড় মজবুত করে। ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে ভালো উৎস হল সূর্য। তাই শিশু ও মা দুজনকে আলো বাতাসে থাকতে হবে। তবে শীতের দেশে গেলে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এমনটাই বলছে বৃটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। আবার খাবার থেকে সব পুষ্টি চাহিদা পূরণ সম্ভব না হলে এই ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট থেকে মায়েদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হতে পারে। কোনো সাপ্লিমেন্ট বা ওষুধ সেবনের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ায় ভালো।

মিনারেল বা খনিজ

দুগ্ধদানকারী মায়েদের জিংক, আয়রন, আয়োডিন ও ক্যালসিয়ামের মত খনিজের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। দুধ, ডিম, দেশি মাছ, মাংস এবং আয়োডিনযুক্ত লবণে আয়োডিন পাওয়া যায়। এসব খাবারের পাশাপাশি দুধ, বাদাম ও মটরশুঁটি জিংক ও ক্লোরিনের বড় উৎস। CDC এর তথ্য মতে, একজন মা কে প্রতিদিন ২৯০ মাইক্রো গ্রাম আয়োডিন এবং ৫৫০ মিলিগ্রাম কোলিন খাওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে একজন মায়ের ক্যালসিয়াম লাগে ১০০০-১৫০০ মিলিগ্রাম। ক্যালসিয়ামের এই চাহিদা পূরণে খাদ্য তালিকায় দুধ, দই, পনির, হাড় সহ মাছ, মাংস খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডাল, গরু ও খাসির কলিজা, মাংস, দুধ ও ডিম থেকে আয়রন মিলে।

বুকের দুধ খাওয়ানো মা যা এড়িয়ে চলবেন

তবে এমন কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের এড়িয়ে চলাই ভালো। নিম্নোক্ত খাবারগুলো খেতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

ক্যাফেইন

যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ লাইন জার্নাল ও কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তথ্য মতে মায়ের দুধের মাধ্যমে ক্যাফেইন অল্প পরিমাণে হলেও শিশুর শরীরে যেতে পারে। ক্যাফেইন এর প্রভাবে শিশু উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে। যার ফলে সে ঘুমাতে চাইবে না। দিনে ১/২ কাপ বা ৩০০ মিলিগ্রাম চা খেতে পারেন একজন মা। কিন্তু তার বেশি নয়। 

কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক এবং ডার্ক চকলেটেও ক্যাফিন রয়েছে। তারপরও যদি খেতেই হয় তাহলে সবচেয়ে ভালো হয় দিনে ১ কাপ কফি, ১ কাপ চা, ১ ক্যান এনার্জি ড্রিংক বা ৫০ গ্রামের মতো চকলেট বার খাওয়া। চা খাওয়ার যদি অনেক অভ্যাস থাকে তাহলে বাজারে বিভিন্ন হারবাল চা পাওয়া যায়, সেগুলো খেয়ে দেখতে পারেন।

খাবারে ক্যাফেইন এর পরিমাণ

  • এক মগ ফিল্টার কফিঃ ১৪০ মিলিগ্রাম 
  • এক মগ ইনস্ট্যান্ট কফিঃ ১০০ মিলিগ্রাম 
  • ১ টি ২৫০ মিলিলিটার ক্যান এনার্জি ড্রিঙ্কঃ ৮০ মিলিগ্রাম 
  • এক মগ চাঃ ৭৫ মিলিগ্রাম 
  • ১টি ৫০ গ্রাম প্লেন চকলেট বারঃ ৫০ মিলিগ্রাম 
  • এক বোতল কোলাপানীয় (৩৫৪ মিলিলিটার)   ঃ ৪০ মিলিগ্রাম

এলার্জি যুক্ত খাবার

মায়ের যদি কোন খাবারে এলার্জি থাকে, যেমন দুধ খেলে পেট ফেঁপে যায়, চিনা বাদাম খেলে বুক ফুলে যায় কিংবা বেগুন খেলে মুখ চুলকায় এসব খাবার পুষ্টিকর হলেও না খাওয়াই ভালো। তবে এলার্জি না থাকলে খেতে কোন বাধা নেই বলছেন পুষ্টিবিদরা।

পারদযুক্ত মাছ

সামুদ্রিক মাছ প্রোটিনের একটি অন্যতম উৎস এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের জন্য এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ। তবে সামুদ্রিক খাবার কোনগুলো খাচ্ছেন, কি পরিমানে খাচ্ছেন, সেটার উপরে লাভ-ক্ষতি নির্ভর করে। যেমন সামুদ্রিক মাছে কিছু পরিমাণ হলেও পারদ থাকে। যা মাছের মাংসে জমা হয় এবং মায়ের দুধের মাধ্যমে তা শিশুর শরীরে চলে যেতে পারে। এটা শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এমনটাই দাবি বৃটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের। তবে সপ্তাহে ২-৩ বেলা ৪ আউন্স করে মাছ খেলে কোন ক্ষতি নেই।

তেল-মসলাদার খাবার, প্রসেসড ফুড

স্তন্যদানকারী মায়েদের অতিরিক্ত তেলেভাজা ও মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো। খাদ্যবাহিত রোগের সংক্রমণ এড়াতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সেই সঙ্গে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ভালো করে রান্না করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। অনেক মা রান্নার ঝামেলা এড়াতে প্রসেসড ফুডের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন বাচ্চাকে স্তন্যপান করান এমন মায়েদের প্রসেসড ফুড থেকে দূরে থাকাই ভালো।

মদপান ও ধূমপান

গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চার জন্মের পর মদ, ধূমপান, পরোক্ষ ধূমপান, তামাক জাতীয় পণ্য থেকে দূরে থাকতে হবে। এসব শিশুর বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। এদিকে স্তন্যদানকারী মায়েদের যে কোন ঔষধ খাওয়া, কসমেটিকস পণ্য বা প্রসাধনী ব্যবহার করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মায়ের শরীর অপুষ্ট থাকলে, সর্দি জ্বর হলে, পেটে গ্যাস হলে, ঘুম কম হলে তার পরোক্ষ প্রভাব পড়বে তার শিশুর উপর তাই মায়ের যত্ন নেয়া অনেক জরুরী।

মায়ের খাদ্যাভাসের কারণে শিশুর কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে খেয়াল করুন বাচ্চা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে কিনা, তার ত্বকে রেস দেখা দিচ্ছে কিনা।এছাড়াও পেট ফাঁপা, বমি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, শব্দ করে শ্বাস, নেয়া অহেতুক কান্নাকাটি এই বিষয়গুলো দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বিশেষ জরুরী।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url