লিভার ভালো রাখার উপায়

মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো লিভার। অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং জীবন যাপনের ফলে আপনার লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনার লিভারের কার্যকারিতা কমে গেলে ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, দীর্ঘ সময় ক্লান্তি অনুভব করা, হজমের সমস্যা, এলার্জি সহ বিভিন্ন ধরনের অসুখ দেখা দিতে পারে।
লিভার ভালো রাখার উপায়
তাই সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে হলে লিভার কে সুস্থ রাখা প্রয়োজন। এই আর্টিকেলে আমরা লিভার ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে জানব।

ওষুধ সেবনের মাধ্যমে লিভারকে সুস্থ রাখা যায় এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমার ফলে লিভারের চর্বি জমে। যার ফলে লিভারের বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, থাইরয়েডের মতো হরমোন জনিত বিভিন্ন অসুখের কারণেও ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।  সঠিক সময়ে ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা গ্রহণ না করলে লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

লিভার ভালো রাখার উপায়

(১) লো ফ্যাট ফুডঃ আপনার লিভারকে সুস্থ রাখতে হলে আপনাকে ধূমপান, মদ্যপান এবং তেল ও মসলাযুক্ত খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। শুধু তাই নয় লিভার সমস্যা এড়াতে লোহার যুক্ত খাবার থেকেও সাবধান থাকতে হবে। 


বাজার থেকে লো ফ্যাট বা ৯৯ শতাংশ লোয়ার ইন ফ্যাট লেখা ফুড কেনা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এ সকল খাবারে ফ্যাট থাকে না কিন্তু খাবারের মান এবং স্বাদ ধরে রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে চিনি ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত চিনি আপনাদের লিভারের সমস্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
(২) স্ট্রেস থাকলে খাবেন নাঃ আপনার যদি মানসিক স্টেজ বা দুশ্চিন্তা থাকে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত অবস্থায় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ এই অবস্থায় খাবারের হজম সঠিকভাবে হয় না।
(৩) হার্বাল কেয়ারঃ পৃথিবীতে বেশকিছু গাছ রয়েছে যে সকল গাছের শিকড় বা মূল লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যেমন- ড্যানডেলিওন, মিল্ক থিসল বা হলুদের মূল লিভারের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে।
(৪) সাপ্লিমেন্টঃ আমরা অনেকেই হরহামেশায় শারীরিক দুর্বলতার জন্য প্রোটিন বা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে থাকি। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এ ধরনের সাপ্লিমেন্ট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বাজারে এরকম অনেক সাপ্লিমেন্ট রয়েছে যা আপনার লিভারের জন্য ক্ষতিকর। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যে সকল সাপ্লিমেন্ট লিভার ডিটক্সিফাই করতে সক্ষম সেগুলো খেতে পারেন। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি মানব শরীরের লিভার পরিষ্কার এবং সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রোটিনের মধ্যে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিডও লিভার পরিষ্কার রাখার জন্য ভাল। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
(৫) ওষুধ থেকে সাবধানঃ ওষুধ যেমন সুস্থতার জন্য প্রয়োজন তেমনি বেশ কিছু ওষুধ রয়েছে যা আমাদের লিভারের ক্ষতি করে থাকে। তাই যেকোনো অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। কিছু কিছু ওষুধ যেমন- পেনকিলার, টাইলেনল বা কোলেস্টেরলের ওষুধ লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে।
(৬) কোমল পানীয় ত্যাগ করুনঃ অতিরিক্ত চা, কফি এবং অন্যান্য কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন। কফি বা লাল চা শরীরের উপকার করলেও প্রতিমাত্রায় পান করলে এগুলো সরিয়ে ক্ষতি করে থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত যে নিয়মিত পরিমাণ মতো কফি পান করলে লিভার ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ১৪ শতাংশ কমে যায়।
(৭) টক্সিনঃ যেকোনো ধরনের টক্সিন বা কীটনাশক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। এ সকল টক্সিন বা কীটনাশক ত্বকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং লিভারে খারাপ প্রভাব ফেলে। তাই টক্সিন বা কীটনাশক স্প্রে করার প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্প্রে করুন।
(৮) প্লান্ট প্রোটিনঃ শরীরকে সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া জরুরী। প্রোটিনযুক্ত খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এনিমেল প্রোটিনের পরিবর্তে প্লান্ট প্রোটিন লিভারের জন্য বেশি উপযুক্ত। যেমন- ডাল, সবুজ শাক-সব্জি, বাদাম, ফাইবার ইত্যাদি।


(৯) অ্যালকোহল বর্জনঃ লিভার কে সুস্থ রাখতে হলে সকল অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকতে হবে। অ্যালকোহল লিভারের টক্সিন জমা করতে সাহায্য করে। যা লিভারের জন্য খুব ক্ষতিকর।
(১০) হেলদি ফ্যাটঃ ফ্যাট বা চর্বি শরীরের জন্য একটি উপকারী উপাদান। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে পরিমাণ মতো ফ্যাট বা চর্বিযুক্ত খাবার খেতে হবে। লিভার কে সুস্থ রাখতে হলে হেলদি ফ্যাট যুক্ত খাবার যেমন- অলিভ, ওয়ালনাট ইত্যাদি খেতে পারেন।
(১১) লেবুঃ লেবুতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং ডি লিমনেন রয়েছে। লিভারকে পরিষ্কার রাখতে লেবুর এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানটি বেশ কার্যকর। ডি লিমনেন উপাদানটি লিভারের বিভিন্ন এনজাইমকে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি যা এনজাইম তৈরি করতে সাহায্য করে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লেবুতে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের মিনারেল লিভারকে পুষ্টি উপাদান গুলো শোষণ করার শক্তি বৃদ্ধি করে। তাই লিভারকে সুস্থ রাখতে পরিমাণ মতো লেবু পানি পান করুন। প্রয়োজনে আপনি লেবু পানির সাথে মধু ও মিশিয়ে নিতে পারেন।
(১২) খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তনঃ শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনটাই পরিবর্তন আমি দেয়া হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

ফ্যাটি লিভার ভালো রাখার উপায়

লিভারকে ফ্যাটি হওয়া থেকে দূরে রাখতে হলে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। সেটি লিভারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকল খাবার গ্রহণ করতে পারেন সেগুলোর নিচে বর্ণনা করা হলো-
(১) সামুদ্রিক মাছঃ
লিভারের চর্বি কমানোর ক্ষেত্রে ওমেগা থ্রি বেশ উপকারী। সামুদ্রিক মাছ যেমন- স্যালমন, টুনা ও সার্ডিনে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি পাওয়া যায়। লিভার সেলে জমে থাকা অতিরিক্ত চলবে ভাঙতে ওমেগা থ্রি সাহায্য করে এবং লিভারের প্রদাহ কমায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি সাপ্লিমেন্টও গ্রহণ করতে পারেন।
(২) অ্যাভোকাডোঃ
অ্যাভোকাডোতে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট রয়েছে। অ্যাভোকাডো লিভারের চর্বি জমতে দেয় না।
অ্যাভোকাডোতে গ্লাইসেমিক এর পরিমাণ কম থাকে যা লিভার থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে। এভোকাডোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। এ ফাইবার হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যার ফলে শরীরে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
(৩) ওজন কমাতে গ্রিন টিঃ
শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে গ্রিন টি খেতে পারেন। গ্রিন টি আমাদের শরীরে জমে থাকা চর্বিকে শোষণ করে এবং লিভারকে চর্বি জমা থেকে রক্ষা করে। গ্রিন টিতে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যার লিভারের কার্যকারিতা করে।


(৪) সয়া প্রোটিনঃ
শরীরের চর্বি কমানোর জন্য তেফুতে বিদ্যমান সয়া প্রোটিন বেশ কার্যকর। তোফু শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি দূর করতে সাহায্য করে এবং লিভারকে সুস্থ রাখে।
(৫) রসুনঃ
গবেষণায় প্রমাণিত যে লিভার কে সুস্থ রাখার জন্য রসুন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার। রসুন লিভারে জনে থাকা বিষাক্ত পদার্থগুলো দূর করতে সাহায্য করে। যার ফলে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমতে পারে না। এছাড়াও রসুনের প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন।
(৬) বাতাবি লেবুঃ
ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীরা বাতাবি লেবু খেতে পারেন। বাতাবি লেবুতে অতি উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এই উপাদানগুলো শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হতে সাহায্য করে।

লিভার ভালো রাখতে এড়িয়ে চলবেন যেসব খাবার

আধুনিক আরামদায়ক জীবনযাত্রা, খাবার গ্রহণে অনিয়ম এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এর কারণে শরীরে বিভিন্ন রকমের রোগ দেখা দেয়। এ সকল রোগের মধ্যে লিভারের সমস্যা অন্যতম। যেকোনো বয়সে লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। লিভারকে সুস্থ রাখতে হলে কিছু কিছু খাবার অবশ্যই বর্জন করা উচিত। যেমন-
(১) ফাস্টফুডঃ
ফাস্টফুড একটি মুখরোচক খাবার। কিন্তু শরীর এবং স্বাস্থ্যের জন্য এই খাবার মোটেও উপকারী নয়। লিভারের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এই খাবার ক্ষতিকর। অনেকে সকালে না তাই ব্রেডের সাথে জেলি খেয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা বলেন এ ধরনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে ট্রান্সফ্যাট থাকে। নিয়মিত এ ধরনের খাবার ভ্রমণের ফলে লিভারের ক্ষতি হয়ে থাকে।
(২) ভাজা পোড়াঃ
ভাজা পড়া সহজ বিভিন্ন ধরনের খাবারে প্রচুর তেল এবং মসলা থাকে। অনেকেরই এ ধরনের খাবার গ্রহণের ফলে পেটের সমস্যা হয়। এ সকল খাবার লিভারের জন্য অনুপযুক্ত। এ সকল খাবার গ্রহণের ফলে লিভারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
(৩) অ্যালকোহলঃ
এবারের জন্য অন্যতম ভয়াবহ জিনিস হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল লিভার নষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। যা নিয়মিত মদ পান করে থাকেন এক সময় তাদের লিভার কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়।


এবং লিভার সমস্যা জনিত কারণে এদের মৃত্যু হয়ে থাকে। লিভার কে সুস্থ রাখতে হলে অ্যালকোহল বা মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
(৪) অতিরিক্ত চিনিঃ
চিনি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। কিন্তু অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সরাসরি চিনি খাওয়া লিভারের জন্য ক্ষতির কারণ। তিনি যুক্ত খাবার যেমন-  মিষ্টি, ক্যান্ডি, চকোলেট নিয়মিত খেলে পরবর্তী সময়ে লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
(৫) ময়দাঃ
বেশি পরিমাণে ময়দা দ্বারা তৈরি খাবার গ্রহণের ফলেও লিভারের সমস্যা হতে পারে। ময়দা দিয়ে তৈরি করা খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকা। ময়দা দিয়ে তৈরি করা প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবারগুলো গ্রহণের ফলে ভবিষ্যতে আপনার লিভার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ সকল খাবার বর্জন করলে আপনি আপনার লিভার কে সুস্থ এবং কার্যক্ষম রাখতে সক্ষম হবেন।

লিভার মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। লিভার আমাদের খাবার হজম করতে সাহায্য করে। লিভার সুস্থ না থাকলে ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, দীর্ঘ সময় ক্লান্তি অনুভব করা, হজমের সমস্যা, অ্যালার্জি সহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। প্রধানত খাদ্যাভ্যাসের কারণে লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। লিভারকে সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url