গরুর কোন রোগের কি ঔষধ - গরুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির একটি অন্যতম অংশ জুড়ে রয়েছে গবাদি পশুপালন বা খামার।খামারে বিভিন্ন পশুর মধ্যে সবচাইতে প্রধান লাভজনক পশু পালন হল গরু পালন। গরু পালন করতে গিয়ে আমরা নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়ে থাকি। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম সমস্যা হলো গরুর রোগ।এ সকল রোগ নিরাময়ের জন্য গরুর কোন রোগে কি ওষুধ দিতে হবে এটা নিয়ে আমরা দ্বিধান্বিত থাকি।

গরুর কোন রোগের কি ঔষধ

উপযুক্ত সময়ে গরুর রোগের  উপযুক্ত ঔষধ দিতে না পারলে অনেক সময় আমাদেরকে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। গবাদি পশুর প্রায় সবগুলো রোগই মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী। তাই পশুর প্রাণ বাঁচাতে রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথেই চিকিৎসা দেয়াটা জরুরী। তাই আজকের আলোচনায় আমরা গরুর কোন রোগের কি ওষুধ সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

ভূমিকা

গরুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা থাকলে আকস্মিক পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নেয়াটা অনেকটা সহজ হয়। খামারে বা বাড়িতে গবাদি পশু লালন পালন করতে গেলে গরুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে ধারণা থাকাটা আবশ্যক। তাই আসুন আমরা গরুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে জেনে নেই।

    ক্ষুরা রোগ

    গরুর একটি ভাইরাস জনিত রোগ। গরুর বিভিন্ন রোগের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এটি একটি বায়ুবাহিত রোগ যার কারণে খুব সহজে এক পশু থেকে অন্য পশুতে ছড়ায়। দুইটি ক্ষুর আছে এমন সকল প্রাণী এই রোগে আক্রান্ত হয়।

    লক্ষণ

    • গরুর প্রচণ্ড জ্বর আসবে। জ্বরের মাত্রা ১০৫°-১০৬° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
    • জিহ্বা, মুখ ও পায়ে ফোসকা পড়বে।
    • গরুর খাওয়া-দাওয়া অরুচি থাকবে।
    • মুখে লালা ঝরতে পারে।

    চিকিৎসা

    • শরীরের ক্ষতস্থানগুলো জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
    • গরুকে তুলনামূলক তরল এবং নরম খাবার দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
    • গরুর থাকার জায়গাটা যেন শুকনো এবং পরিষ্কার হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
    • অ্যান্টিবায়োটিক অথবা সালফোনামাইড ইনজেকশন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

    তড়কা রোগ

    এটি গরুর ব্যাকটেরিয়া জনিত মারাত্মক রোগ। এ রোগের জীবাণু আছে এমন কোন খাবার খেলে গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়। গরু থেকে এই রোগ অনেক সময় মানুষের মধ্যেও ছড়ায়।

    লক্ষণ

    • গরুর শরীরে জ্বর থাকবে ১০৪°-১০৭° ফারেনহাইট
    • গরুর খাবারের রুচি থাকবে না।
    • দেহে কাঁপুনি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ও পেট ফাঁপা থাকতে পারে।
    • শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন নাক, মুখ, প্রস্রাব ও মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

    চিকিৎসা

    • এন্টিবায়োটিক ও এন্টিসিরাম দিতে হবে।
    • প্রত্যেকদিন গরুর শিরায় ১০০-২৫০ মিলি এন্টিসিরাম ইনজেকশন দিতে হবে।
    • দিনে ২ বার করে ৫ দিন পেনিসিলিন জাতীয় ইনজেকশন পেশিতে দিতে হবে।

    বাদলা রোগ

    এটি গরুর একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। এই সংক্রামক রোগটি বর্ষাকালে ছড়ায় বলে একে বাদলা রোগ বলা হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে বন্যার ফলে এ রোগ ছড়ায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন বন্যার পানি ঘাসে লাগে তখন গরু সেই ঘাস খেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

    লক্ষণ

    • গরুর শরীরের আক্রান্ত স্থান ফুলে যাবে।
    • আক্রান্ত স্থানে পচন ধরবে।
    • আক্রান্ত গরু ব্যথার কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে।

    চিকিৎসা

    • প্রথমে গরুর শিরায় ক্রিস্টালিন পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে হবে।
    • পরবর্তীতে আক্রান্ত পেশিতে অর্ধেক মাত্রায় প্রোকেইন পেনিসিলিন দিনে ২ বার করে ৫-৭ দিন দিতে হবে।

    গলাফোলা রোগ

    জীবজন্তুর বিভিন্ন রোগের মধ্যে গলা ফোলা রোগটি বেশি মারাত্মক। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। গরু এবং মহিষের মধ্যে এই রোগটি বেশি দেখা যায়। এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে এ রোগটি বেশি পরিলক্ষিত হয়।

    লক্ষণ

    • দেহের তাপমাত্রা আকস্মিক বৃদ্ধি পায়।
    • গলার নিচের দিকে ফুলে যায়। ফোলা অংশ ক্রমশ গলা থেকে বুকের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
    • শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় স্বাভাবিকের থেকে বেশি শব্দ হয়। 
    • নাক মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।

    চিকিৎসা

    • প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০-২০ মিলি ওটেট্রো ভেট অথবা ২-৭ মিলি এসাইপিলিন অথবা স্ট্রেপটোপেন ৫-৭ মিলি ইনজেকশন মাংসের প্রয়োগ করতে হয়।
    • প্রতিটি ইনজেকশন ৩-৫ দিন ২৪ ঘন্টা পর পর দিতে হয়।
    • এর সাথে দিনে ২/৩ বার মাংসে অ্যান্টিহিস্টামিন ইনজেকশন ৫-৭ মিলি দিতে হবে।

    ম্যাসিটাইটিস

    প্রাণীর ওলানের গ্লান্ডুলার টিস্যুর প্রদাহকে ম্যাসিটাইটিস বা ওলান ফোলা বা ঠুনকো রোগ বলে। খামারে দুগ্ধবতী গাভীদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এতে গরুর দুধ উৎপাদন কমে যায় এবং শরীরে ব্যাপক ক্ষতি হয়।

    লক্ষণ

    • গরুর ওলান ফোলা থাকে।
    • ওলানে ব্যথা হয়।

    চিকিৎসা

    • এন্টিবায়োটিক ও ব্যাথানাশক ইনজেকশন ওলানে দিতে হয়।
    • স্যালাইন দিতে হবে।

    পেট ফাঁপা

    অতিরিক্ত গ্যাস জমে পেট ফাঁকা রোগের সৃষ্টি হয়। দানাদার খাবার বা ইউরিয়া জাতীয় খাবার গরু বেশি খেলে পেটে হজমের সমস্যা হয় এবং পেট ফুলে ওঠে। লতাযুক্ত ঘাস, ভাত ইত্যাদি খাবার একবারে বেশি পরিমাণে খেলে গরুর পেট ফাঁপা রোগ হয়।

    লক্ষণ

    • গরুর পুরো পেট ফুলে যায়।
    • গরু অস্থির হয়ে ঘন ঘন ওঠাবসা করে।
    • পেটে লাথি মারে এবং মাঝে মাঝে মাটিতে গড়াগড়ি করে।
    • গরু খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়।
    • আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলে পেটে বিশেষ শব্দ হয়।

    চিকিৎসা

    • গ্যাস নিরাময়ের ইনজেকশন দিতে হবে।

    রক্ত-প্রস্রাব বা ব্যাবেসিওসিস 

    এটি জীবজন্তুর আঁটুলিবাহিত প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। এ রোগের আরেকটি নাম রেড ওয়াটার ফিভার। এ রোগে আক্রান্ত হলে পশুর রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙ্গে যায়। রক্তের লোহিত কণিকা গুলো ভেঙ্গে গিয়ে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। ফলে প্রস্রাব লাল দেখায়।

    লক্ষণ

    • ক্ষুধামন্দা ও শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকবে।
    • রক্তশূন্যতা ও রক্ত প্রস্রাব দেখা দিবে।
    • শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে।

    চিকিৎসা

    • প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৮ মিলি পরিশ্রত পানিতে ডিমিনাজিন ডাইএসিটুরেট (৬%) মিশিয়ে মাংসপেশীতে ইনজেকশন করতে হবে।
    • এছাড়া ত্বকের নিচে একবারইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপিয়োনেট ইনজেকশন বেশ কার্যকরী।

    শেষ কথা

    গবাদি পশুর জীবন বাঁচাতে তথা আমাদের বৃহত্তর আর্থিক ক্ষতি থেকে বাঁচতে উপরোক্ত আলোচ্য বিষয়গুলো সম্বন্ধে প্রারম্ভিক জ্ঞান থাকাটা জরুরী। উপরিউক্ত গরুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবস্থা নিন।

    এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

    পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
    এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

    T Time Trend এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

    comment url